নোটিশ:

নোটিশ: "এটা আমার ব্যক্তিগত ব্লগ। এই ব্লগ থেকে কেউ আমার অনুমতি ব্যতীত কোন গল্প অন্য কোথাও প্রকাশ করতে পারবেন না।"

বুধবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৭

দাদাকে মনে পড়ে


  ১৯৯৮ সাল। আজ থেকে ১৯ বছর আগের কথা। তখন আমি ডায়েরি লিখতাম। প্রতিদিনের ঘটনাগুলো প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রাখতাম। এখন আর ডায়েরি লেখা হয় না। দীর্ঘদিন পর ব্যক্তিগত বুকসেলফ খুলতেই আমার প্রথম ডায়েরিটি দেখতে পাই। ডায়েরিটি হাতে নিয়ে একের পর এক স্মৃতির পাতা উল্টাতে থাকি। হঠাৎ চোখ পড়ে ১৮/১০/১৯৯৮ ইং তারিখের লেখাটির প্রতি। দুয়েক লাইন পড়তেই বুঝতে পারলাম এই দিনটি আমাদের পরিবারের একটি শোকের দিন। এই দিনে আমার দাদা পান্ডব আলী মৃত্যুবরণ করেন।
  ১৯৯৮ সালের বন্যা ছিল বাংলাদেশে সংঘটিত প্রলয়ংকারী বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে সংগঠিত এই বন্যায় দেশের প্রায় ৬০% এলাকা ডুবে যায়। এই বন্যার স্থায়ী ছিল এলাকাভেদে ২০-২৫ দিন। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় যখন বন্যার পানি আমাদের বাড়ির উঠানে চলে আসেতখন আমার দাদা বার্ধক্য জনিত অসুখে বিছানায় পড়ে যায়। দিন দিন খাওয়া দাওয়া কমে যায় এবং এক সময় বিছানা থেকে উঠার মতো ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
   আমাদের গ্রামের কবরস্থান তখন পানির নিচে ডুবে গেছে। আত্মীয় স্বজন সবাই তখন আশংকা করছে এই অবস্থায় যদি দাদার মৃত্যু হয় তাহলে কোথায় দাফন-কাফন করবেন। সবাই দাদার জন্য দোয়া করছেন আল্লাহ যেন আমার দাদাকে সুস্থতা দান করেন এবং আর যদি সুস্থতা দান না করেন তাহলে যেন অন্তত বন্যার পানি বাড়ি থেকে সরে গেলে মৃত্যু হয়। আল্লাহ আমাদের আত্মীয় স্বজনদের দোয়া কবুল করছেন। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পরই দাদার মৃত্যু হয়েছে। এই জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
   ১৯৯৮ সালে আমি রসুলপুর ওসমান মোল্লা ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় দশম শ্রেণীতে পড়ি। এই মাদ্রাসাটি নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলায় অবস্থিত। আমি তখন রসুলপুর গ্রামে সালাহ উদ্দিন (মোক্তার) সাহেবের বাড়িতে লজিং থেকে লেখাপড়া করতাম। দীর্ঘ একমাস যাবত দাদা অসুস্থ্য ছিলেন এই খবর আমি জানতাম না। কারণ তখন মোবাইল ফোনের প্রচলন ছিলো না। ১৯৯৬ সালে এদেশে মোবাইল আসলেও তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মোবাইল ফোন কেনার মতো সমর্থ ছিলো না। তাই তখন চিঠিই ছিলো একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। আর জরুরী খবর লোক মারফত পৌঁছানো হতো।
   আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বন্যার পানি দ্রুত বাড়ায় মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। মাদ্রাসা বন্ধ থাকার পরও বন্যার কারণে আমি তখন বাড়িতে যেতে পারিনি। আমি যে ঘরে থাকতাম সেখানেও পানি চলে আসছিল। তখন মনটা খুবই ছটফট করতো। বাড়ির কোন খবরা খবর পাইতাম না। দাদা-দাদিআম্মা ও ছোট ভাই বোনদেরকে নিয়ে চিন্তা করতাম। কখন পানি কমবে আর কখন বাড়িতে যাব সেই চিন্তায় অস্থির থাকতাম। বন্যার পানি যখন কমে গেল তখন ১৪ অক্টোবর আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। বাড়িতে এসে দেখি আমাদের বাড়ি থেকে পানি নেমে অনেক নিচে চলে গেছে। আশে পাশের আবাদী জমি কিছুটা শুকিয়ে গেছে।
   আমি ঘরে প্রবেশ করতেই আম্মা ও বড় ফুফু আমাকে দেখে কাঁদতে লাগলো। দাদাকে তখন বিছানায় শায়িত দেখলাম। দাদার দিকে চোখ পড়তেই আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। একি দেখছি আমি! আমার দাদার এমন অবস্থা কেনদাদার শরীর একেবারে কঙ্কাল হয়ে গেছে। মাংস শুকিয়ে চামড়া হাড়ের সাথে মিছে গেছে। শুকনো মাংস থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দাদার কাছে গেলাম। দাদার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দাদা কোন কথা বলতে পারছেন না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ঠোঁট নাড়াচ্ছেন কিছু কথা বলতে চাচ্ছেন কিন্তু মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। আমি তখন বুঝতে পারছি দাদা আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন কিন্তু কোন কথা শুনছিও না বুঝছিও না। তখন আমার কান্নায় বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। দাদার মুখের কাছে কান নিয়ে কথা শুনার চেষ্টা করলাম কিন্তু তারপরও কিছু শুনতে পেলাম না। তখন ভাবলাম ওনার কথা আমি বুঝতে না পাড়লেও নিশ্চয় ওনি আমার কথা শুনবেন। আমি তখন দাদাকে বললামদাদা আমি আপনাকে জানা অজানায় কত কষ্ট দিয়েছি। আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমি আপনার জন্য দোয়া করি আল্লাহ যেন আপনাকে দ্রুত সুস্থ করে দেন।
   দাদা তখন মাথা নাড়ালেন।
   কতদিন আগে কোন তারিখে আমি সর্বশেষ বাড়িতে আসছি আর দাদার সাথে কথা বলেছি আমার তখন মনে নেই। দাদার সাথে কথা না বলার আক্ষেপ রয়ে গেল। আম্মার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম দাদা এখন আর শক্ত খাবার খেতে পারেন না। শুধু পানি ও ফলের জোস খেতে পারেন। বিছানা থেকে উঠার ক্ষমতা নেই। তাই বিছানায় প্রশ্রাব-পায়খানা করছেন। দাদার অসুস্থতার পর থেকে আমার আম্মা একাই দাদার সেবা যত্ন করছেন। তবে মাঝে মাঝে আমার ছোট ফুফু দাদাকে দেখে গেছেন। বড় ফুফু মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে এখানে এসে দাদার কাছে ছিলেন। দাদার জন্য তখন নামাজ পড়ে দোয়া করতাম আল্লাহ যেন দ্রুত আমার দাদাকে আরোগ্য দেন। ইতোমধ্যে দাদার অসুস্থতার খবর শুনে অনেক আত্মীয়স্বজনরা তাঁকে দেখতে আসেন এবং দাদার জন্য দোয়া করেন।
   আমি দুইদিন বাড়িতে ছিলাম। ১৬ অক্টোবর দাদা-দাদিফুফু ও আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রসুলপুর চলে আসলাম। বন্যার পর মাদ্রাসা খুললো। তাই পরদিন মাদ্রাসায় যাই। ১৮ অক্টোবর সকাল বেলা ঘুম হতে উঠে পড়তে বসলাম। কেন যেন আজ পড়ায় মন বসছে না। মনটা শুধু ছটফট করছে আর দাদার কথা মনে পড়ছে। ৮টার সময় গোসল করে খাওয়ার পর মাদ্রাসায় গেলাম। মাদ্রাসায় গিয়ে ক্লাস করছি। ৫ম ঘন্টার সময় দপ্তরী এসে আমাকে বললোআমির তোমার বাড়ি থেকে একজন লোক আসছে তোমার সাথে দেখা করবে। আমি তখন হুজুরের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে দুতলা থেকে নিচে নেমে আসলাম। নিচে আসতেই দেখি আমার কাকা (আব্বার চাচাতো ভাই) মোকার হোসেন ও আমার ছোট ভাই রবিউল্লাহ। তাদেরকে দেখে হঠাৎ চমকে গেলাম। ব্যাপার কি পরশু মাত্র বাড়ি থেকে আসলাম আর আজই তারা এখানে এসে উপস্থিত! আমি তখন কাকাকে বললামকি ব্যাপার কাকাআপনিতো কোনদিন এখানে আসেননিআজ হঠাৎ এখানে আসলেন?
   কাকা বললেনতোমার দাদা মারা গেছে তাই তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখানে আসলাম।
   আমি সঙ্গে সঙ্গে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন বলে চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। কখন মারা গেছে কাকা?
   আজ সকাল ছয়টায়। জলদি চল। তুমি বাড়িতে গেলে জানাজা হবে। কারণ তোমার বড় ভাই বাড়িতে নেই।
   বড় ভাই কোথায়?
   তোমার মামাকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিতে ঢাকা গেছে।
   হঠাৎ দাদার মৃত্যু সংবাদ শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। যেই দাদা আমাকে এতো ভালোবাসতো সেই দাদা আজ নেই। আমি বাড়িতে গেলে দাদা আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে মাঝে টাকা দিত। কোথাও গেলে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেত। আর ভাবতে পারছি না।
   কাকা বললোকাঁদবে না। সবাইকে একদিন মরতে হবে। তাড়াতাড়ি চল।
   আমি চোখ মুছে বললামএকটু দাঁড়ান আমি ছুটি নিয়ে আসছি বলেই উপরে ক্লাশে ঢুকে হুজুরকে আমার দাদার মৃত্যু সংবাদ দিলাম। হুজুর শুনে আমার দাদার জন্য দোয়া করে বললেনতুমি বাড়িতে চলে যাও।
   তখন বাজে ১২:০০টা। কাকাকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত লজিং বাড়িতে আসলাম। পড়ার রুমে বইগুলো রেখে লজিং বাড়ির সবাইকে দাদার মৃত্যুর সংবাদ শুনিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। নরসিংদী আসতে আসতে বেলা ২:০০ টা বেজে গেল। চারটার সময় আমাদের গ্রামের পাশে সোনাবাল্লা লঞ্চ ঘাটে এসে লঞ্চ থামল। লঞ্চ থেকে নেমে দ্রুত হেঁটে ৪:৩০ মিনিটে বাড়িতে আসলাম। বাড়িতে এসে দেখি পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ আগে দাদার জানাজা ও দাফন-কাফন সম্পন্ন করে লোকজন বাড়িতে চলে আসল। আমাকে দেখে বড় ফুফুছোট ফুফু জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আমিও চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলাম না। কেঁদে কেঁকে ফুফুকে,আম্মাকে বললামআমার জন্য কি আরেকটু সময় অপেক্ষা করা গেল না?
   আম্মা বললোতোর বড় ভাই ও তোর জন্য মুরুব্বীরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে কিন্তু যথাসময়ে কেউ না আসায় সবার সিদ্ধান্তে ৩:০০ টার সময় দাফন কাফন শেষ করছে। আফসোস করিস নাদাদার জন্য দোয়া কর আর এখন গিয়ে কবরে মাটি দিয়ে আস।
   বিকাল ৫:০০টার দিকে আমি গোরস্থানে গিয়ে দাদার কবর দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। দাদার কবরে নিজ হাতে মাটি দিয়ে দাদার জন্য দোয়া করলাম।
   আজ দেখতে দেখতে দাদার মৃত্যুর ১৯টি বছর পার হলো। দাদাকে ছাড়া দীর্ঘ ১৯ বছর যাবত আমার আব্বার পরিচালনায় আমাদের সংসার চলছে।
   উল্লেখ্য যেদাদার মৃত্যুর সময় দাদার একমাত্র ছেলে আমার আব্বা শরীফ হোসেন ও আমার মেজো ভাই আবু ইউসুফ ওমান প্রাবাসে ছিলেন বিধায় দাদার পাশে থাকতে পারেন নি। কিন্তু আমরা বাকি ৪ ভাই দেশে থাকা সত্ত্বেও যোগাযোগের মাধ্যম সহজ না হওয়ায় আমিআমার বড় ভাই আকবর হোসেনসবার ছোট ভাই রবিউল্লাহ জানাজায় শরিক হতে পারিনি। শুধুমাত্র ছোট ভাই ওমর ফারুক দাদার জানাজায় উপস্থিত ছিল।
   দাদার মৃত্যুর আগে ছবি তোলাটাও ছিল দুর্লভ। তখন স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলা যেতো। কিন্তু দাদা ছবি তোলতেন না। আমাদের কারোর কাছে তখন ব্যক্তিগত ক্যামেরা ছিল না বিধায় দাদার ছবি ধারণ করে রাখতে পারিনি। কিন্তু দাদার ছবি আমার হৃদয়ে গেথে আছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই ছবি মুছবে না।
   ১৯টি বছর পার হলো আমরা কোনদিন দাদার মৃত্যু দিবস পালন করিনি। কারণ ইসলামে মৃত্যুদিবস পালন করার কোন বিধান নেই। আল কোরআনের কোন আয়াত বা কোন হাদীস দ্বারা কারো মৃত্যুবার্ষিকী পালনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
   ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানইসলামেও শোক পালনের নির্দিষ্ট নিয়মনীতি রয়েছে। তা হলো কেউ মারা গেলে তিন দিন শোক পালন করবে। তিন দিন পর শোক পালনের কোনো সুযোগ নেইবরং চতুর্থ দিন থেকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করবেতবে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী চার মাস দশ দিন অথবা গর্ভস্থিত সন্তান (যদি থাকে) প্রসব হওয়া পর্যন্ত শোক পালন করবে।
   রাসুল (স) বলেছেনকোনো মহিলা যে আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাস করেসে যেন তিন দিনের অতিরিক্ত শোক পালন না করে,তবে স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে। (বুখারিমুসলিম)।
   অতএব ইসলামের বিধান হলো কেউই তিন দিনের অতিরিক্ত শোক পালন করবে না। শুধু মহিলারা স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন অথবা সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত শোক পালন করবেন।
   নিজের আত্মীয়স্বজনের জন্য অন্যের নিকট দোয়া চাওয়া যেতে পারে। টাকার বিনিময়ে কোন মাওলানা ভাড়া করে দোয়া করানোর বিধানও ইসলামে নেই। তবে নিজে দোয়া করাই অধিক উত্তম। বিশেষ করে পিতামাতার জন্য সন্তান সব সময়ই দোয়া করবে।
   রাসুল (স)কে জনৈক সাহাবি প্রশ্ন করলেন হে আল্লাহর রাসূলপিতামাতার মৃত্যুর পর তাদের প্রতি সন্তানের আর কিছু করণীয় আছে কিরাসুল (স) বললেনহ্যাঁপিতা মাতা মৃত্যুর পর তাদের প্রতি চারটি করণীয় অবশিষ্ট থাকে ১. তাদের জন্য সব সময় দোয়া করা। তাদের মাগফেরাতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। ২. তাদের ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা৩. তাদের মাধ্যমে যাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়েছেতাদের সাথে আত্মীয়তার সুসম্পর্ক বজায় রাখা৪. তাদের বন্ধুদের সম্মান করা। (আবু দাউদ)।
   উপরোক্ত হাদিসের আলোকে আমরা সবাই দাদার জন্য যার যার জায়গা থেকে দোয়া ও তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছি।
   ইসলামে মৃত্যুর তৃতীয় দিবসে কুলখানি করা এবং চল্লিশতম দিবসে চেহলাম করার কোনো বিধান নেই। এমনিভাবে মৃত্যু দিবস পালন করামৃত্যু দিবস উপলক্ষে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের বিশেষ আয়োজন করা ইসলামে নেই। ইসলামে মৃত ব্যক্তিদের ব্যাপারে যা করণীয় রয়েছে তা হলোসব সময়ই তাদের জন্য দোয়া করা। এর জন্য কোনো দিনক্ষণ ঠিক করার প্রয়োজন নেই। যেকোনো সময়ই দোয়া করা যায়।
   তাইতো তথাকথিত এইসব বেদআত দিবস প্রথা বাদ দিয়ে আমরা দাদার জন্য সব সময় নিজেরা দোয়া করি। যেমন দৈনিক পাঁচবার নামাজের সময়জুমআর নামাজের সময়দুই ঈদের নামাজ শেষে দাদার কবর জেয়ারতের সময়শবে বরাত ও শবে কদরের রাতসহ ইসলামের বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে। আমরা এবং আমার ফুফাতো ভাইয়েরা বাড়িতে আসলে প্রায়ই দাদার কবর জিয়ারত করে দোয়া করি।
   অন্যান্য দিনের মতো দাদার মৃত্যু দিনটিও প্রতি বছর আমাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। আমরা অনেকে মনে রেখেছি আবার অনেকে হয়তো মনে রাখি নাই। তাই বলে কেউ দাদাকে ভুলে যাইনি। নির্দিষ্ট দিনে দাদাকে স্মরণ না করে সারা বছরই দাদাকে স্মরণ করি। যারা মৃত্যু দিবস পালন করে তারা সারা বছর মৃত ব্যক্তিকে ভুলে থাকে। মৃত্যু দিবসে তার নামে মিলাদ মাহফিল করিয়ে মৃত ব্যক্তির ক্ষতি সাধন করে থাকে।
   মৃত্যুর সময় দাদা এক ছেলে (আমার আব্বা) ও দুই মেয়ের সংসারে ১৬ জন নাতী নাতনি রেখে যান। যারা আজ দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। ১৬ জন নাতী নাতনি থেকে দাদার উত্তারাধীকার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
   দাদার স্বপ্ন ছিল তাঁর উত্তরাধীকারদের মধ্য থেকে কেউ একজন আলেম হবেন এবং তাঁর জানাজা পড়াবেন। দাদা সবসময় আমাদের পরিবার ও আমার দুই ফুফুর পরিবারের সবাইকে মাদ্রাসায় পড়ার জন্য উৎসাহ দিতেন এবং ওনার ইচ্ছা অনুযায়ী আমার বড় ফুফুর দুই ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়ানো হয়।
   আমাদের পরিবারে আমরা পাঁচ ভাই সবাইকে দাদা পর্যায়ক্রমে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমরা সবাই কম বেশি মাদ্রাসায় পড়াশুনা করলেও কেউ প্রকৃত আলেম হতে পারলাম না। যথেষ্ট এলেম থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত পরিমাণ আমলের অভাবে আলেম হতে পারিনি। তবে মাদ্রাসায় পড়াশুনা করার কারণে আমরা কেউ ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়নি। আমাদের পরিবারের সবাই আল্লাহকে ভয় করে এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামজ পড়ে। মদগাজাবিড়িসিগারেট খায় না। ধর্মীয় রীতি নীতি মেনেই আমাদের জীবন যাপন চলছে।
   আমরা পাঁচ ভাই দাদার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও আমার দুই ফুফাত ভাই দাদার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন। একজন হচ্ছেন হাফেজ মাওলানা মো: আলমগীর হোসেন। আরেকজন হচ্ছেন মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী। ওরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী একজনসু-বক্তালেখক,  দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের প্রধানমসজিদের খতিব ও বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন। তাছাড়া দাদা আমার বড় বোনকে একজন আলেমের সাথেই বিয়ে দেন।
   আমার বড় ভাই আকবর হোসেন তিনি বর্তমানে পরিবারসহ ওমান প্রবাসী ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। মেজো ভাই আবু ইউসুফ দীর্ঘ ওমান প্রবাস জীবন শেষ করে বর্তমানে ট্রেইলারের ব্যবসা করেন। আমার ছোট ভাই ওমর ফারুক স্ট্রেশনারীর ব্যবসায়ী ও সবার ছোট ভাই রবিউল্লাহ সেও ওমান প্রবাস জীবন শেষ করে দেশে কাপড়ের ব্যবসা করছেন। আর আমি চাকরি না পেয়ে বর্তমানে কম্পিউটার ফটোকপির ব্যবসা করছি।
   দাদার মৃত্যুর সময় আমরা বড় তিন ভাই জানাজা পড়ানোর মতো সমর্থ ছিলো কিন্তু মৃত্যুর সময় কাছে উপস্থিত ছিলাম না বিধায় তা সম্ভব হয়নি। ফুফাতো ভাইয়েরাও নরসিংদী ও ঢাকাতে থাকায় তাদের কাছে দেরিতে খবর পৌঁছেছে বিধায় যথাসময়ে জানাজায় উপস্থিত হতে পারেন নি। তখন আলেম হিসেবে একমাত্র আমার দুলাভাই উপস্থিত ছিলেন। সবার সম্মতিক্রমে দুলাভাই দাদার জানাজা পড়ান। বর্তমানে আমার দুলাভাইও পরলোকগমন করেন। এই দুলাভাইয়ের জানাজাও তখন আমার ফুফাতো ভাই হাফেজ আলমগীর হোসেন পড়ান। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি আমাদের পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে আল্লাহ যেন আমাদের পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদের কারো না কারোর মাধ্যমে জানাজার পড়ানোর ব্যবস্থা করবেন।
   পরিশেষে সবার কাছে বিনীত অনুরোধ করব আপনারা সবাই আমার দাদার জন্য বেশি বেশি দোয়া করবেন আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতবাসী করেন। আমিন।


   ১৫/০৯/২০১৭খ্রি:

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন